সকল মেনু

বাংলাদেশ সম্পর্কে ধারণা বদলানোই প্রধান চ্যালেঞ্জ

শ্যামল দত্ত : ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, দারিদ্র্য আর রাজনৈতিক সংঘাতের একটি দেশ – এই পরিচয়ে পরিচিত ছিল একসময় বাংলাদেশ। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে সমৃদ্ধ অর্থনীতি, সামাজিক উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন ও স্বনির্ভর জাতি হিসেবে বাংলাদেশের একটা নতুন পরিচয় তৈরি করার কাজটি অত সহজ নয়। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো সম্পর্কে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর এই নেতিবাচক মনোভাবের পেছনে নানা রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণ আছে। একটি অনুন্নত দেশ নিজস্ব শক্তিশালী চেহারা নিয়ে এবং অর্থনীতিতে বলিয়ান হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে যাবে – এটা অনেকেই চান না। ইউরোপ-আমেরিকার দীর্ঘদিনের উপনিবেশিক মানসিকতাই এর প্রধান কারণ। ছোট ছোট দেশগুলোকে তাদের বিভিন্ন চেহারার উপনিবেশ হিসেবেই দেখতে তারা পছন্দ করে।

এসব দেশের গণতন্ত্রের জন্য তাদের নিজস্ব সংজ্ঞা আছে, অর্থনীতির জন্য তাদের বানানো নিজস্ব মডেল আছে। এর বাইরে গিয়ে কেউ নিজের উদ্যোগ ও অভিনবত্ব দিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যাবে, অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধিশালী হয়ে যাবে – এমন অনেক দেশকে তারা গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়। এসব কারণে কোনো দেশ যদি নিজস্ব চেষ্টায় অর্থনৈতিকভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চায়, তাদের সেসব উন্নয়নের পেছনে নানা প্রশ্ন ও শর্ত জুড়ে দেয়। কিন্তু এসব প্রশ্নকে উপেক্ষা করেও অনেক দেশ এগিয়ে গিয়েছে। তার প্রমাণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকায় আছে।

কিন্তু পশ্চিমা অনেক দেশ ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংস্থা বাংলাদেশকে পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে উল্লেখ করলেও বাংলাদেশ সম্পর্কে ধারণা এখনো স্পষ্ট নয়। উন্নয়নের চিত্রটিকে স্বীকার করে সুশাসন, ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্র ইত্যাদি জুড়ে দিয়ে তারা অনেক প্রশ্ন তোলে। কিন্তু নিজেদের ক্ষেত্রে এগুলো প্রযোজ্য মনে করে না। অন্যদিকে এটাও বাস্তবতা যে, পশ্চিমা জনগোষ্ঠীর মনোজগতে বাংলাদেশ সম্পর্কে যে চিত্রটি দীর্ঘ সময় ধরে তৈরি হয়ে আছে, সেটিকে রাতারাতি বদলে দেয়াও সম্ভব নয়। কিন্তু সেই অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কাজটি তো করতে হবে। এই নতুন বাংলাদেশের নতুন চেহারার সঙ্গে কোনো না কোনো সময় কাউকে না কাউকে দায়িত্ব নিয়ে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে।

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে ১৯৭১ সালের পর কেউ কেউ তলাবিহীন ঝুড়ি বা ‘বাস্কেট কেস’ বলেছিলেন। দশকের পর দশক ধরে খাদ্য সংকট, পরমুখাপেক্ষী অর্থনীতি, উন্নয়নের জন্য বিদেশের কাছে হাত পেতে বসে থাকার যে বাংলাদেশ- সেখান থেকে নিজের পায়ে দাঁড়ানো অন্য এক বাংলাদেশকে পরিচিত করাতে হবে বিশ্বের কাছে। বর্তমানে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাকশিল্প রপ্তানির দেশ বাংলাদেশে সত্তরের দশকের শুরুতে রেশনে কাপড় দেয়া হতো একটি শার্ট সেলাইয়ের জন্য। কিন্তু এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনটি কীভাবে সংঘটিত হলো? কীভাবে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলো? কীভাবে মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়? কীভাবে শাকসবজি উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশ চতুর্থ? কীভাবে সামাজিক সব সূচকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের কাছ থেকে এগিয়ে আছে?

স্বাধীনতা লাভের পর থেকে জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ। চাষাবাদের জমি কমেছে বিপুলভাবে। কিন্তু অবাক করার মতো কাণ্ড- বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে গত চার দশকে দ্বিগুণেরও বেশি। এসব কি আসলেই ম্যাজিক, নাকি দূরদর্শী কোনো নেতৃত্বের অত্যন্ত সূচারুরূপে বানানো পরিকল্পনার ফসল? সামাজিক গবেষকগণ এই নিয়ে গবেষণা করতে পারেন, কিন্তু অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে একটা বিপ্লব ঘটে গেছে, সেটা সাধারণ মানুষের চোখে স্পষ্ট। বলার অপেক্ষা রাখে না- যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপ্লব এবং ডিজিটালাইজেশন এক্ষেত্রে অন্যরকম অন্যতম ভূমিকা রেখেছে।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতায় এসে গ্রামকে অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু করে যে কর্মকাণ্ড শুরু করেছিল, তাতে পশ্চিমা অনেক দেশের সমালোচনা ছিল। কৃষি ক্ষেত্রে ভর্তুকি নিয়ে প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেছিল পশ্চিমা অনেক দেশ এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংগঠন। বাংলাদেশের আজকের কৃষিবিপ্লবের পেছনে অন্যতম ভ‚মিকা রাখছে এই ভর্তুকি-ব্যবস্থা। মোবাইল টেলিফোনের মতো একটি আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার কাজটিও শুরু হয়েছিল সে সময়। মানুষের জীবনে আমূল পরিবর্তন এনেছে এই যোগাযোগ ব্যবস্থা। দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে ২০০৮ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন বললেন ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’, তখন অনেকেই ধারণাই করতে পারেনি জিনিসটি কী? ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত ডিজিটাল তথ্যসেবা কিংবা করোনার টিকা দেয়ার জন্য সুরক্ষায় অ্যাপ- এক নতুন ডিজিটাল বাংলাদেশের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় সবাইকে। দেশের ১৪ কোটি মানুষের হাতে মোবাইল, ৮ কোটি মানুষের হাতে ইন্টারনেট- এক নতুন বৈপ্লবিক বাংলাদেশের চেহারা তুলে ধরে। ছাত্রছাত্রীর বৃত্তি থেকে সামাজিক সুরক্ষা খাতের সব সহায়তা গ্রাম পর্যায়ে দরিদ্র মানুষের হাতে পৌঁছে যাচ্ছে এই মোবাইল টেকনোলজির মাধ্যমে। মাত্র ৩০ বছর আগেও এসব উদ্যোগ ছিল মানুষের কল্পনা শক্তির বাইরে।

কিন্তু এই পরিবর্তিত বাংলাদেশকে বিদেশিদের কাছে চেনাবে কে? তাদের মাথায় তো বাংলাদেশ সম্পর্কে এখনো দারিদ্র্য, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা আর বিধ্বস্ত অর্থনীতির এক ছবি গেঁথে আছে। এই নতুন বাংলাদেশকে চেনানোর দায়িত্ব নিয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন যুক্তরাষ্ট্রের চারটি শহরে রোড শোর আয়োজন করেছিল। নতুন পরিবর্তিত এক বাংলাদেশের কথা বলা, বাংলাদেশের এই অগ্রগতির নতুন চেহারা তুলে ধরা এবং বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ কেন আকর্ষণীয় গন্তব্য? সেই বিষয়টি উল্লেখ করা ছিল এই রোড শোর মূল লক্ষ্য।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাত ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এমপি এক পর্যায়ে বলেই ফেললেন, আমি এখান থেকে এই ধারণাটি নিয়ে যাচ্ছি যে, বাংলাদেশ সম্পর্কে পশ্চিমাদের মনোজাগতিক পরিবর্তন আনাটাই আমাদের মনে হয় প্রধান দায়িত্ব হবে। নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, লস অ্যাঞ্জেলেস এবং সান্তা ক্লারা- যাকে আমরা সিলিকন ভ্যালি হিসেবেই জানি- প্রতিটি রোড শোতে তিনি এই উপলব্ধির কথাই বলেছেন। প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রশ্ন এসেছে- বাংলাদেশে কেন বিনিয়োগ করতে যাবে একজন বিনিয়োগকারী? মেক্সিকো বা ভিয়েতনামে বিনিয়োগ না করে কেন বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবে? সস্তা শ্রম ছাড়া বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য আর কি সুবিধা আছে? দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের এসব কঠিন প্রশ্নের জবাব ঠাণ্ডা মাথায় দিয়েছেন রোড শোর উদ্যোক্তারা। বাংলাদেশে বিনিয়োগের লাভ অনেক বেশি, সরকার বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কর রেয়াতসহ কী কী সুবিধা দেয়- তার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেছেন তারা।

সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলাম তার সাবলীল উপস্থাপনায় প্রতিটি রোড শোতে এক পরিবর্তিত বাংলাদেশের গল্প বলেছেন। তার বক্তব্য ছিল, বাংলাদেশ এখন ঋণ চায় না, বাংলাদেশ এখন চায় ব্যবসায়িক অংশীদার ও বিনিয়োগে সহায়তা। একটি উন্নত ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের শেয়ারবাজার- যেটি আসলে দেশের অর্থনীতি ও বিনিয়োগের ক্ষেত্র তৈরির প্রাণশক্তি- তার অন্তর্নিহিত শক্তির কথাটি তুলে ধরেছেন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে। বিশ্বজুড়ে করোনার কারণে বিপর্যস্ত অর্থনীতির মধ্যেও বাংলাদেশের শেয়ারবাজার চিহ্নিত হয়েছে অন্যতম শক্তিশালী একটি বিনিয়োগের ক্ষেত্র হিসেবে।

এই স্বীকৃতি এসেছে বাংলাদেশ থেকে নয়, আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের কাছ থেকে। বাংলাদেশে একজন সফল বিদেশি বিনিয়োগকারী গ্রামীণফোনের সিইও ইয়াসির আজমান কিংবা ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি সেলিম হোসাইন অথবা একজন অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির কর্ণধার আরিফ খান তাদের সফলতার গল্পগুলো তুলে ধরেছেন প্রতিটি রোড শোতে। বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম অথবা বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকার নির্বাহী চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল নজরুল ইসলাম বলেছেন বাংলাদেশের বিনিয়োগ সুবিধাগুলোর কথা। অর্থনৈতিক অগ্রগতির কারণে বাংলাদেশে আজ একটি অভ্যন্তরীণ বাজার তৈরি হয়েছে- তার কথা উল্লেখ করেছেন তারা।

অন্যদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে রেকর্ড, পদ্মা সেতুসহ সড়ক ও বন্দর অবকাঠামো সুবিধা তৈরি করে বিনিয়োগের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেয়া হয়েছে। দেশে ১০০টি ইকোনমিক জোন তৈরি করে ওয়ান স্টপ সার্ভিসের মাধ্যমে সুবিধাটি এখন বিনিয়োগকারীদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশের ১ কোটি ১০ লাখ প্রবাসী আছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। প্রবাসীরা বলেছেন, তাদের মধ্যে অনেকেই আছেন সফল উদ্যোক্তা। তাদের যদি বাংলাদেশে বিনিয়োগের উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়া যায়, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি এই প্রবাসী উদ্যোক্তারাই পাল্টে দেবে বাংলাদেশটাকে। একজন বাংলাদেশি উদ্যোক্তা কালী প্রদীপ চৌধুরী যদি ক্যালিফোর্নিয়ার অবকাঠামো ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে পাল্টে দিতে পারেন, একজন মোহাম্মদ মাহতাবুর রহমান যদি পুরো মধ্যপ্রাচ্যের পারফিউম ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেন, একজন কাজী হাবিব যদি জাপানে বসে ইউরোপের ফুড চেইন নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন- বাংলাদেশের অর্থনীতিকে তারা শক্তিশালী করতেও ভূমিকা রাখতে পারবেন। দরকার শুধু বাংলাদেশ সম্পর্কে পশ্চিমাদের ‘প্রি কনসিভ মাইন্ডসেট’ পাল্টানোর ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ। মনোজগৎ পরিবর্তনে বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার এই কঠিন কাজটি শুরু করেছে সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন বিভিন্ন দেশে রোড শো আয়োজনের মধ্য দিয়ে। এখন তাদের এই উদ্যোগের পাশাপাশি অন্যদের এগিয়ে আসার পালা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top