সকল মেনু

একটি ক্যন্সারের গল্প

রাত ৮ টা, ধানমন্ডি ইবনেসিনা হাসপাতাল। বায়োপসি টেষ্ট। রিপোর্টের অপেক্ষা। আমি আর আমার এক বেয়াই। চিন্তিত রিপোর্টে কি আসতে পারে? ক্যান্সার? না টিভি। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি। ক্যান্সার যেন না আসে। রিপোর্ট আসবে রাত ১২ টার পর। কিছুই যেন ভালো লাগছিল না। রিপোর্টটা আগেভাগে জানতে হবে তাই পাশের হাসপাতালে চলে গেলাম। ল্যাব’র একজন কর্মচারীকে সেটিং দেই; রিপোর্টটা যেন একটু আগে জানিয়ে দেয়। রাত তখন ১০টা। চা-বিড়ি চলছে…দু’জনই চুপচাপ। ঐ লোককে ফোন দেয়া হলো, ওনি বললেন টেনশন নিয়েন না। টিভির দিকেই আছে। আমাদের মুখে একটু হাঁসি। আধা ঘন্টা পর আবারও বলছে- টিভির দিকেই আছে। টিভি এখন সাধারণ একটি রোগ। কিন্তু ক্যান্সার তো…। আবার যখন ফোন দেয়া হলো- অপরপ্রান্ত থেকে লোকটি আর ফোন ধরছে না। আমাদের টেনশন বেড়ে গেল। তার মানে কি বিপদ? হ্যা …অনেকবার ফোন দেয়ারপর লোকটি বললো- ভাই সংবাদ ভালো না। মানে ক্যান্সার ধরা পরেছে। কথাটা শোনে আমার বেয়াই চুপ হয়ে গেল; মুখটা মলিন। আমার চোখের কোনা দিয়ে পানি ঝড়ছে। তখনই বুঝতে পেরেছিলাম আমার বোন আর পৃথীবিতে বেশিদিন বাঁচবে না। তারপর ক্যান্সার চিকিৎসা। ফাঁকে একটু বলতে হয়- বাংলাদেশের বড় বড় প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতেও ‘শান্তির মায় মারা গেছে’। ডাক্তার সাব’দের সাথে কথা বলাই যেন মুশকিল!! সকাল ১১ টায় রোগি দেখার টাইম থাকলে তারা আসবেন বিকাশ ৫ টায়। রাগ হলেও কিচ্ছু করার নাই। কি এক্টা ভাব যে তাদের। এই ইতিহাস বললে…আসলটা ভুলে যাবো।
যাই হোক- ক্যান্সারের চিকিৎসা চলছে ক্যামো থেরাপি। আমরা জানি ক্যামো দিলে চুল পড়ে যায়। কিন্তু আমরা হয়তো ভাবছিলাম আমাদের বোনটি অনেকদিন বেঁচে থাকবে তাই ৭০ হাজার করে এক একটা ক্যামোর সাথে ৬৫ হাজার করে এক একটি এন্টিবডি দেয়া হয়েছেছিল। যাতে চুল না পরে। এভাবেই চলতে থাকে চিকিৎসা। আর আমাদের হাসপাতাল বিউটি। এই ভালো আবার এই খারাপ। দুটো ঈদ আমাদের পরিবার করতে পারেনি। এর মধ্যেই দু বার মনে হয়েছিলো- বোনটি মনে হয় আজকেই পৃথিবী থেকে চলে যাচ্ছে। বিশ্বাস করুন-আমার বোনের সারাটা শরীরে শুধু সুঁইয়ের চিহ্ন ছিল। যেন ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল পুরো শরীর। তবুও সে শক্তছিল। বাঁচার জন্য মানুষ কতটা ব্যাথা নিতে পারে তাও দেখেছিলাম তখন। এভাবেই ৬টি ক্যামোর পর সিদ্ধান্ত নেয়া হয় অপারেশনের। বাংলাদেশে তখন পুরো লকডাউন। সব দেশের সাথে যোগাযোগ বন্ধ। ইন্ডিয়া যাওয়ার সব বর্ডারও বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তারপও আমাদের চেষ্টা থামেনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনালয় থেকে বিশেষ পাশ নিয়ে বোনটিকে নিয়ে ভারতের ব্যাঙালোর যায়। ‘ডাক্তার দেবীসেঠির হাসপাতাল’ (ব্যাঙালোর)। ডাক্তাররা সিন্ধান্ত নেয় ওপেন সার্জারি করবে। ডাক্তারদের পরাপর্শ অনুযায়ি তার অপারেশন হয় এবং দুইদিন পর জ্ঞান ফিরে। ৮ সে.মি. কোলন ফেলে পুরো পেট চেসে ক্যামো দিয়ে ওয়াস করা হয়েছিল। অপরারেশন ভালোই হয়েছিল। ডাক্তাররা বলেছিলেন-অনেকদিন বাঁচবে। আমার বোনও অনেক খুশি। আমরা অত্যন্ত ভাবছিলাম সে হয়তো ৫/১০ বছর বাঁচবে। এর মধ্যে তার তিনটি সন্তান আরো বড় হয়ে যাবে। ঐ সময় ইন্ডিয়া টানা ৬ মাস থেকে দেশে ফিরে আসে। আবার পরীক্ষা করানোর জন্য ইন্ডিয়া যায়। এভাবে ভালোই চলছিলো। কিন্তু ৫/৬ মাস ভালো থাকার পর আবারও সে অসুস্থবোধ করে। এবার আর শেষ রক্ষা হয়নি। দ্বিতীয়বার ক্যান্সার ধরা পরার পর তার আর চিকিৎসার কোন রাস্তা ছিল না। কোন হাসপাতালে নিতেও চায়নি। তাদের ভাষা ছিল- আমরা সবোর্চ্চ চিকিৎসা করে ফেলেছি। এখন আর কিছুই করার নেই। একটি সুস্থ মানুষ হাসপাতালে আসার পর আস্তে আস্তে ২৩ দিনের মাথায় চলে গেল। তখনও তার ধারনা ছিল-সে বাঁচবে। সে মাঝে মধ্যে মন খারাপ করেছে। তার ধারনা ছিল আমরা তার চিকিৎসা করছি না। কিন্তু তাকে বলা যাচ্ছিলো না- তার আর কোন চিকিৎসা নাই। একটা সময় বাধ্য আমরা বলতে চেষ্টা করি তাকে, আমরা কিছু করতে পারছি না। সেও একসময় বুঝে যায়। সুন্থ মানুষটি আস্তে আস্তে আমাদের চোখের সামনে বিদায় নেয়। আমরা কিছুই করতে পারিনি। তার শেষ ইচ্ছে ছিল- তার বড় ছেলেটি সামনে এসএসসি পরিক্ষা দিবে তার রেজাল্ট কেমন হয় শুধু সেটা দেখে মরতে চায়। কিন্তু উপরের ডাক চলে আসে। আল্লাহ তাকে নিয়ে যান। সেদিন রাত… মা ফোন দিয়ে বলছিল- বাবারে তোর বোনের অবস্থা খারাপ। বুঝেছি যা হবার হয়ে গেছে। বাসা থেকে দৌড়ে বের হই…রাত তখন ১ টার উপরে । বাইক ধরে দেখি তেল নাই। কোনো কিছুই ভাবিনি তেল বিহীন বাইকটি মিরপুর ২ থেকে ঠেলে নিয়ে সোজা চলে যাই মিরপুর ১ নম্মর পাম্পে। তেল নিয়ে বাইক চালানোর সময় মনে হচ্ছিলো বাইকের চাকা আলাদা হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছিলো বাইকটি রাস্তায় উড়ছে…তারপর হাসপাতাল চোখের সামনে একটি লাশ-
ক্যান্সার ২৫০ রকম। চিকিৎসা নেই। চলে যেতেই হয়। হবে অনেকে ক্যান্সার থেকে বাঁচতে হলে নিজেদের অনেকভাবে সচেতন করা যায়। যদি আমরা সচেতন হই। অনেক রকম ক্যান্সার থেকে বাঁচতে পারবো। আর একটা বিষয় কোন ক্যান্সারই প্রথম দিকে ধরা মুশকিল। ধরাই পরে এক বছর হয়ে যাওয়ার পর। এরমধ্যে এই মরণব্যাধি আপনাকে অনেকটা গ্রাস করে ফেলে। তাই সচেতন হওয়াটা জুরুরি।
আমরা গানে গানে আসছি কিছুটা সচেতন করতে। এ কোন বিশাল উদ্যোগ নয়। সামর্থ অনুযায়ী কিছু সচেতনতা উপহার দেয়া। সামনেও দিতে চাই। সবার দোয়া চাই-
আমার বিশ্বাস প্রতিটি ক্যান্সার পরিবারের গল্পই হৃদয়বিদারক । শুধু গল্পটা আলাদা …আলাদা

 

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top