লোকসংগীত মানেই যেন মাটি, মানুষ, আর আত্মার কথা। এই সংগীতের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে চার দশক পেরিয়েছেন এক নির্লোভ শিল্পী—আবু বকর সিদ্দিক। সময় বদলেছে, গান বদলেছে, শ্রোতার রুচিও বদলেছে। কিন্তু বদলায়নি এই মানুষটির গানকে ভালোবাসার ধরন। বরং সময়ের স্রোতে নিজের অবস্থানকে আরও গভীরে গেঁথে নিয়েছেন তিনি—বাংলা সংগীতের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে।
শুরুটা যেভাবে
সত্তরের দশকের শেষ দিকে যখন বাংলাদেশে সংগীতচর্চা মূলত শহরকেন্দ্রিক, তখন আবু বকর সিদ্দিক লোকসংগীতকে কেন্দ্র করে আত্মপ্রকাশ করেন। শেকড়ের টান থেকে উঠে আসা গলা, আর মাটির ঘ্রাণ মিশে থাকা সুর তাকে এক আলাদা পরিচিতি দেয়। বাংলাদেশ বেতারে তালিকাভুক্ত শিল্পী হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও, তার কণ্ঠে এক ধরনের আধ্যাত্মিকতা ধরা পড়তে থাকে, যা লোকসংগীতের পাশাপাশি সুফি ধারার গানেও তাকে গ্রহণযোগ্য করে তোলে।
গানে যে দর্শন
আবু বকর সিদ্দিক শুধুমাত্র গান গাইতে আসেননি—তিনি গানকে বেছে নিয়েছেন আত্মার সাধনার মাধ্যম হিসেবে। “হিংসা নিন্দা দূর কর হে মমিন মুসলমান”, “কান্দ রে মন”, কিংবা “বুকে প্রেমের ক্ষত” গানগুলোতে যেমন পাওয়া যায় আত্মবিশ্লেষণের ছায়া, তেমনি তার কণ্ঠে তুলে ধরা প্রেম বা দুঃখের গানগুলোতেও পাওয়া যায় মানবিকতা ও জীবনঘনিষ্ঠতা।
তানভীর মোকাম্মেলের ‘জীবনঢুলী’ চলচ্চিত্রে আবু বকর সিদ্দিকের গাওয়া “মায়ের মাটি আঁচল ছেড়ে” ও “ঢাক তুমি বাজো” গান দুটি আজও দর্শকের হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করে। সেখানেও ছিল তার গলায় মাটির ঘ্রাণ, যেটি শহুরে ব্যস্ততাকেও থমকে দেয়।
নতুন প্রজন্মের সঙ্গে যোগাযোগ
আবু বকর সিদ্দিক কেবল অতীতে থেমে যাননি। বরং সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল ‘Abu Bakar Sidique Music Media’ চালু করে ডিজিটাল মাধ্যমেও তিনি তার শ্রোতাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। সেখানে গাওয়া “তোর জ্বালার মালা” গানটি গীতিকার সাইফুল বারীর কথায় নতুন প্রজন্মের কাছেও প্রশংসিত হয়েছে।
লোভ নয়, সাধনা ছিল মূলমন্ত্র
চার দশকের এই পথচলা সহজ ছিল না। কিন্তু তিনি কখনো পেশাদার সংগীতজীবনের চটকদার জগতে পা রাখেননি। কখনো বিজ্ঞাপন, অ্যালবামের মোহ বা মিডিয়ার লাইমলাইট তাকে টানেনি। বরং গানকেই তিনি দেখেছেন জীবনের একমাত্র পাঠশালা হিসেবে। সেই জগতেই তিনি ছাত্র, সেই জগতেই তিনি সাধক।
এক জীবন্ত অধ্যায়
আজকের সময়েও যখন অনেক শিল্পী ক্ষণিকের জনপ্রিয়তায় হারিয়ে যান, তখন আবু বকর সিদ্দিক তার কণ্ঠ, দর্শন এবং মাটির গন্ধে তৈরি গান নিয়ে টিকে আছেন। তিনি শুধু একজন কণ্ঠশিল্পী নন—তিনি একজন গানের জীবনযোদ্ধা। তার চল্লিশ বছরের সংগীতসাধনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সংগীত শুধু বিনোদন নয়—সংগীতও হতে পারে আত্মার মুক্তি।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।