সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভুল তথ্যের বেশিরভাগই রাজনীতি সংশ্লিষ্ট। আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই হার আরও বাড়ছে। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে প্রায় অর্ধেক ও পরের তিন মাসে ৬৩ শতাংশ ভুল তথ্য রাজনীতি সংশ্লিষ্ট ছিল বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠান ডিসমিসল্যাব। (৩০ অক্টোবর) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য প্রকাশ করে প্রতিষ্ঠানটি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজনীতি বিষয়ক ভুল তথ্যগুলোর অর্ধেকের বেশি (৫২%) মিছিল-সমাবেশ, সংঘর্ষ-সহিংসতা ও রাজনীতিবিদ-রাজনীতি সংক্রান্ত ভুয়া বক্তব্য এবং বিবৃতি সংক্রান্ত। আর ১৮ শতাংশ নেতাকর্মীদের নির্যাতন, হত্যা, রাজনীতিবিদ, দলের অপরাধ ও দুর্নীতি নিয়ে।
যেসব ঘটনা নিয়ে রাজনীতি বিষয়ক ভুল তথ্য বেশি ছড়িয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো, জুলাইয়ে গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পদযাত্রাকে কেন্দ্র করে সংঘাত, আগস্টে শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী এবং সেপ্টেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন। তবে রাজনীতির বাইরে জুলাইয়ে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়া এবং সেপ্টেম্বরের শেষে খাগড়াছড়িতে সংঘাতকে ঘিরে বেশি ভুল তথ্য ছড়িয়েছে। এক মারমা শিক্ষার্থীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার পর চট্টগ্রামের জেলাটিতে সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল।
এতে আরও বলা হয়, ভুল তথ্য ছড়ানোর মাধ্যম হিসেবে ভিডিওর ব্যবহার বাড়তে দেখা গেছে। তৃতীয় প্রান্তিকে ৬৬% ভুল তথ্য ভিডিওর মাধ্যমে ছড়িয়েছে। তবে এপ্রিল–জুন তুলনায় গ্রাফিক কার্ড, ছবি ও লিখিত পোস্টের ব্যবহার কমেছে।
ডিসমিসল্যাবসহ বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট আটটি ফ্যাক্টচেকিং ওয়েবসাইটে প্রকাশিত যাচাই প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এই চিত্র পাওয়া গেছে।
চলতি বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে ওয়েবসাইটে সবমিলিয়ে ১,৩৪৫টি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। একই ভুল তথ্য নিয়ে একাধিক ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান যাচাই প্রতিবেদন প্রকাশ করলে একটিকে ইউনিক বা স্বতন্ত্র হিসেবে ধরা হয়েছে। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ওয়েবসাইটগুলোতে প্রকাশিত ৯৬০টি স্বতন্ত্র ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন হয়েছিল। যা এর আগের তিন মাসের তুলনায় ৫ শতাংশ কম।
এদিকে, রাজনৈতিক অপতথ্যগুলোকে ১২টি ভাগে ভাগ করেছে ডিসমিসল্যাব। তা হলো, ভুয়া বক্তব্য-বিবৃতি, চরিত্র হনন, মিছিল-সমাবেশ, নির্যাতন-মৃত্যুর অভিযোগ, দুর্নীতি-অপরাধের অভিযোগ, আদালত-কারাগার ও গ্রেপ্তার সংক্রান্ত, সংঘর্ষ-সহিংসতা, বিদেশী প্রভাব বিস্তারের ষড়যন্ত্র, সরকারি কার্যকলাপ, আওয়ামী লীগের বিদেশী কার্যকলাপ, নির্বাচন ও অন্যান্য।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, রাজনৈতিক ভুল তথ্যের ক্ষেত্রে পুরোনো মিছিল ও সমাবেশের ছবি-ভিডিও সাম্প্রতিক দাবিতে প্রচার এবং এক রাজনৈতিক দলের মিছিল-সমাবেশ অন্য কোনো দলের দাবিতে প্রচারের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে। মোট ছড়ানো ৬০৮টি রাজনৈতিক ভুল তথ্যের ১৯ শতাংশই ছিল এই ধরনের মিছিল ও সমাবেশ সংক্রান্ত ভুয়া দাবি। প্রতি ১০ পোস্টের নয়টিতেই আওয়ামী লীগের মিছিল বা সমাবেশের দৃশ্য বলে দাবি করা হয়েছে।
গত জুলাইয়ে গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পদযাত্রাকে কেন্দ্র করে সংঘাতের পর আওয়ামী লীগ দেশব্যাপী হরতাল কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছিল। এই হরতালের সমর্থনে ও ১৫ আগস্টে শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীকে কেন্দ্র করে ভুয়া মিছিল-সমাবেশের দাবি বেশি ছড়াতে দেখা গেছে।
কিছু ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ বা অঙ্গ সংগঠনের মিছিল দাবিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি ভিডিও ছড়াতে দেখা গেছে। যেমন, ঢাকা বা চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের মিছিল দাবিতে এআই দিয়ে বানানো ভিডিও ছড়িয়েছে। একটি ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সত্যিকারের মিছিলে এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষের সংখ্যা বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে।
একই প্রবণতা অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে। বেশ কয়েকটি সম্পাদিত ভিডিওতে এনসিপি নেতারা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে নিয়ে স্লোগান দিয়েছেন বলে মিথ্যা দাবি করা হয়েছিল। কিছু ভিডিওতে এনসিপি নেতারা তারেক রহমানের পক্ষে স্লোগান দিচ্ছেন এবং বাংলাদেশে স্বাগত জানাচ্ছেন বলা হয়েছে। আবার কিছু ভিডিওতে এনসিপি নেতারা তারেক রহমানের বিরুদ্ধে অপমানজনক স্লোগান দিয়েছেন বলে দাবি করা হয়েছে।
অপরদিকে রাজনৈতিক সংঘর্ষ, সহিংসতা সংক্রান্ত ১৮% ভুল তথ্য ছড়িয়েছে। এক্ষেত্রে পুরোনো বা ভিন্ন কোনো সংঘর্ষ-সহিংসতার দৃশ্যকে সাম্প্রতিক দাবিতে প্রচার করা হয়েছে। কোথাও আবার অন্য কোনো দেশের ছবি-ভিডিও বাংলাদেশের দাবি করে ছড়ানো হয়েছে।
যেমন, গত জুলাইয়ে ফেসবুকে একটি মারধরের ভিডিও শেয়ার করে বলা হয় সেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হল দখলকে কেন্দ্র করে শিবির ও ছাত্রদলের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা। কিন্তু পরে দেখা যায় ভিডিওটি ২০১৮ সালের। সেটি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আন্দোলনের সময় সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার দৃশ্য। আবার ফরিদপুরে এনসিপির নেতাকর্মীদের উপর জনগণের আক্রমণের দৃশ্য দাবিতে প্রচারিত হয়েছিল কেনিয়ার একটি আন্দোলনের ভিডিও। বিএনপি-জামায়াতের সংঘর্ষের দাবিতে প্রচারিত হতে দেখা গেছে ভারতে গ্রাম পঞ্চায়েতের একটি সভায় দুই দলের সংঘর্ষের ঘটনার ভিডিও।
এছাড়া, জুলাই মাসে গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশ চলাকালীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ ঘটে। তখন তাইওয়ানের একটি ভিডিও ছড়িয়ে বলা হয় যে গোপালগঞ্জে সেনাবাহিনী ট্যাংক থেকে গুলি চালাচ্ছে। সেনা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে অর্ধশতাধিক মানুষ নিহত ও গণহত্যা চালানো হয়েছে বলেও দাবি করা হয়। এর দুই মাস পর ডাকসু নির্বাচন পরবর্তী সংঘর্ষের অভিযোগে একাধিক ভুল তথ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। নির্বাচনে ছাত্রশিবির বিজয়ী হওয়ার পর ছাত্রদল ভোট বর্জন করেছে বলে ভুয়া তথ্য ছড়ানো হয়। তাছাড়া, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ ও পুলিশ বা ছাত্রশিবির কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়েছে এমন তথ্যও ছড়িয়ে পরে।
ডিসমিসল্যাব জানায়, রাজনৈতিক ভুল তথ্যের আরেকটি প্রধান বিষয় হলো ভুয়া বক্তব্য বা বিবৃতি। যা মোট রাজনৈতিক ভুল তথ্যের ১৬%। অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন উপদেষ্টা, রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, কিংবা রাজনীতি নিয়ে সাধারণ মানুষের ভুয়া মন্তব্য বা বক্তব্য ছড়াতে দেখা গেছে। এক্ষেত্রেও দেখা গেছে এআই দিয়ে বানানো ভিডিওর ব্যবহার। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস দীর্ঘদিন ধরেই ভুল তথ্য ছড়ানোর অন্যতম লক্ষ্যবস্তু হিসেবে রয়েছেন। কোথাও বলা হয়েছে তিনি আগামী জাতীয় নির্বাচন সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর পদ্ধতিতে হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন বা সুদের ব্যবসা বিশ্বকে বদলে দিতে পারে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মোঃ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর নামেও ছড়িয়েছে বেশ কয়েকটি ভুয়া বক্তব্য-বিবৃতি। যেমন দাবি করা হয়েছে যে, তিনি বলেছেন দুর্গাপুজা হলো মদ ও গাঁজার সমাবেশের উৎসব। যদিও যাচাইয়ে দেখা যায়, তিনি এমন কোনো বক্তব্য দেননি। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সাধারণ মানুষের বক্তব্য দাবিতে অন্তত ১০টি এআই দিয়ে তৈরি ভিডিও ছড়াতে দেখা গেছে। কিছু দাবিতে বলা হয়েছে জনগণ আওয়ামী লীগকে পুনরায় ক্ষমতায় দেখতে চায়, কারণ তাদের সময়ে দেশে উন্নতি হয়েছে। আরও দুটি ভিডিওতে দাবি করা হয়, জনসভায় বক্তারা বিএনপি ও জামায়াতের সমালোচনা করছেন এবং ভোটারদের তাদের সমর্থন না দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন।
একই ধরনের কিছু ভুয়া বক্তব্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে বানিয়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের নামেও প্রচার করা হয়েছে। এসব ভিডিওতে উভয় পক্ষকেই একে অপরকে দোষারোপ করতে শোনা যায়। গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগ কর্মী, সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে সংঘর্ষের পর একটি এআই দিয়ে বানানো ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে দেখা যায় একজন পুলিশ কর্মকর্তা সংবাদ সম্মেলনে সেনাবাহিনীকে সহিংসতার জন্য দায়ী করছেন। অপর ভিডিওতে সেনাবাহিনীর এক সদস্যের বক্তব্য হিসেবে বলা হয় দেশে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব সেনাবাহিনীর নয়, পুলিশের।
সরকারি কার্যকলাপ নিয়েও ভুল তথ্যের বিস্তার হয়েছে। এই প্রান্তিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বা উপদেষ্টাদের বিভিন্ন কার্যক্রম ঘিরেও ভুল তথ্য ছড়াতে দেখা গেছে। কিছু দাবিতে বলা হয়েছে সরকার সশস্ত্র বাহিনীর জন্য ছয় মাসের রেশন বন্ধ করে দিয়েছে বা কয়েকজন উপদেষ্টা পদত্যাগ করেছেন।
অন্যদিকে, রাজনৈতিক অপতথ্যের প্রায় প্রতি দশটির মধ্যে একটি ছিল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মৃত্যু বা নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে। কোথাও ভুল দাবিতে বলা হয়েছে আওয়ামী লীগের এক সাবেক সংসদ সদস্য কারাগারে মারা গেছেন। আবার কোথাও বলা হয়েছে আওয়ামী লীগ বা এর অঙ্গসংগঠনের কর্মী হবার কারণে কেউ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ফেসবুকে রক্তাক্ত অবস্থায় বসে থাকা এক ব্যক্তির ছবি শেয়ার করে বলা হয় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকায় মারধরের শিকার হন তিনি। তবে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনে বলা হয় আহত ব্যক্তিটি সড়ক দুর্ঘটনার শিকার। আবার গোপালগঞ্জবাসীর হামলায় এনসিপির ২৩ জন নিহত হয়েছেন দাবিতে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট শেয়ার হতে দেখা গেলেও যাচাই প্রতিবেদনে বলা হয় দাবিটি মিথ্যা।
রাজনৈতিক দল বা নেতাকর্মীদের জড়িয়ে দুর্নীতি ও অপরাধের ভুয়া দাবিতে ৮% রাজনৈতিক অপতথ্য ছড়িয়েছে। এমন অন্তত চারটি স্বতন্ত্র ভুল তথ্য ফ্যাক্টচেক হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন চারজন রাজনীতিবিদের বাড়ি থেকে টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। কোথাও বলা হয়েছে বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বাড়ি থেকে টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া এনসিপির নেত্রী সামান্তা শারমিন, তাসনিম জারা বা নেতা নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর বাসা থেকে টাকা উদ্ধার করা হয়েছে বলেও ভুল তথ্য ছড়ানো হয়।
এছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে জামায়াত বা বিএনপির নেতাকর্মীরা ধর্ষণ বা চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত রয়েছেন এমন দাবিতে বেশ কিছু ভুল তথ্য প্রচারিত হতে দেখা গেছে। যেমন, জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা কাউকে ধর্ষণ করেছে বা ধর্ষণের অভিযোগে আটক হয়েছে। চাঁদা না দেয়ায় বিএনপি কর্মীরা হাসপাতালে জোড়া খুন করেছে দাবিতে ছড়ানো হয়েছে ভারতের ভিডিও।
দুর্নীতি-অপরাধের অভিযোগ ছাড়াও রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত জীবন ও আচরণ সংক্রান্ত ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে চরিত্র হননের চেষ্টাও দেখা গেছে কিছু ভুল তথ্যের মাধ্যমে। যেমন, ভিন্ন কোনো যুগলের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি সম্পাদনা করে দাবি করা হয়েছে সেগুলো কোনো রাজনীতিবিদের ছবি। কোথাও বলা হয়েছে কোনো রাজনীতিবিদ পরকীয়া করতে গিয়ে ধরা পড়েছেন। এনসিপি নেত্রী ডা. তাসনিম জারার হাফ প্যান্ট পরিহিত ছবি বা অর্ধনগ্ন ছবি ছড়ানো হয়েছে সম্পাদনা করে।
একটি সম্পাদিত ছবি শেয়ার করে বলা হয়েছে সেটি এনসিপির দুই নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ ও তাসনিম জারার চুম্বনের দৃশ্যে। তবে ফ্যাক্টচেকে দেখা যায় ভিডিওটি ভারতের।
আদালত, কারাগার, গ্রেপ্তার সংক্রান্ত অপতথ্যগুলোতে কোথাও বলা হয়েছে কারাগারে থাকা আওয়ামী লীগ নেতা মুক্তি পেয়েছেন বা গ্রেপ্তার হয়েছেন। যেমন সামাজিকমাধ্যমের পোস্টে বলা হয় আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি জুনাইদ আহমেদ পলক মুক্তি পেয়েছেন। আবার কোথাও বলা হয় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। কিন্তু ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনে বলা হয় দাবিগুলো ভুয়া।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশী প্রভাব সংক্রান্ত কিছু ষড়যন্ত্রতত্ত্ব ছড়াতে দেখা গেছে চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে। যেমন, গত সেপ্টেম্বরে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরের ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লাঠিচার্জের পর এক ব্যক্তির ছবি ছড়িয়ে বলা হয়েছিল তিনি ভারতীয় ভারতীয় গোয়েন্দাসংস্থা ‘র’-এর এজেন্ট। নুরকে হত্যার মিশন নিয়ে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। যদিও যাচাইয়ে দেখা যায় ছবিটি তৈরি করা হয়েছিল এআই দিয়ে।
পাকিস্তানকে জড়িয়েও অপতথ্য ছড়াতে দেখা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর পাঁচটি অ্যাকাডেমিক ভবনে স্যানিটারি ন্যাপকিন ভেন্ডিং মেশিন স্থাপন করেছিল ইসলামী ছাত্রশিবির। সেসময় দাবি করা হয়েছিল এজন্য সহায়তা করেছে পাকিস্তানের একটি সংগঠন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ভারত, ফিলিপাইন, যুক্তরাষ্ট্র, পেরু, মিশর, আয়ারল্যান্ড বা আর্জেন্টিনার সরকার বা বিভিন্ন মন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের বৈধ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করেছেন বা আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বলেছেন– এমন দাবিতে বেশ কিছু ভুয়া তথ্য ছড়াতে দেখা গেছে। এআই দিয়ে বানানো একটি ভিডিওতে আবার দাবি করা হয়েছিল যে ভারতের সংসদে বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তীব্র সমালোচনা করা হচ্ছে।
২০২৪ সালের আগস্টে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতাকর্মী বা সমর্থক বিদেশ থেকে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন– এমন দাবিতেও ছড়াতে কিছু ভুল তথ্য দেখা গেছে। যেমন, পুরোনো একটি ভিডিও শেয়ার করা বলা হয়েছে শেখ হাসিনা দিল্লি থেকে লন্ডন যাচ্ছেন। পাকিস্তানের একটি ভিডিও শেয়ার করে দাবি করা হয়েছে আওয়ামী লীগের সাবেক ছয় মন্ত্রীকে বৈঠকের জন্যে এলাহাবাদে নেওয়া হয়েছে।
নির্বাচন নিয়ে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক (এপ্রিল-জুন) থেকে রাজনীতি-বিষয়ক ভুল তথ্যের একটি অন্যতম বিষয় হয়ে উঠেছে নির্বাচন। তৃতীয় প্রান্তিকেও এই প্রবণতা অব্যাহত ছিল। জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছাড়াও এই প্রান্তিকে বেশ কিছু ভুল তথ্য ছড়িয়েছে ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে। নির্বাচনে ভোট জালিয়াতি হচ্ছে, নির্বাচনকে অস্থিতিশীল করে তোলার জন্য অস্ত্র আনা হচ্ছে– এমন দাবিতে পুরোনো ও অপ্রাসঙ্গিক ভিডিও ছড়িয়েছে। নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণার আগে ছড়াতে দেখা গেছে বিভিন্ন প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট নিয়ে নানা ভুল তথ্য, পরিসংখ্যান। চূড়ান্ত ফল ঘোষণার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষ-সহিংসতা হয়েছে দাবিতেও ভুল তথ্য ছড়িয়েছে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গেও আলাদাভাবে ছড়াতে দেখা গেছে নানা ভুল তথ্য। বিশেষ করে প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন বা পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের পক্ষে-বিপক্ষে ছড়িয়েছে একাধিক ভুয়া উদ্ধৃতি। যেমন, কোথাও দাবি করা হয়েছে আগামী নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতে হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। আবার কোথাও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বরাতে বলা হয়েছে, যাদের নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা নেই, তারাই পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চায়। পিআর ইস্যুতে জামায়াত ও আওয়ামী লীগ জোট করতে পারে– এমন ভুয়া দাবি জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানের বরাতে প্রচারিত হয়েছে।
নির্বাচন বিষয়ক প্রচার-প্রচারণায় দেখা গেছে এআই দিয়ে তৈরি ভিডিওর ব্যবহারও। দিনাজপুর-৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শিবলী সাদিকের পক্ষে প্রচারণায় ব্যবহৃত হয়েছে এমন ভিডিও। জামায়াতে ইসলামীকে ভোট দেওয়া উচিৎ না– এমন বক্তব্য প্রচারিত হয়েছে এআই দিয়ে তৈরি এক ইসলামী বক্তার মাধ্যমে। নির্বাচনে কোন দলের শক্তি কেমন, কার সঙ্গে কার জোট হবে, কোন দল কেমন ভোট পাবে, বা ক্ষমতায় আসলে কী ধরনের ব্যবস্থা নেবে– এমন কিছু ভুল তথ্যও প্রচারিত হয়েছে রাজনৈতিক নেতাদের ভুয়া উদ্ধৃতির মাধ্যমে।
সাম্পতিক সময়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত ভুল তথ্য ছড়ানোর প্রবণতা বেড়েছে বলে জানিয়েছে ডিসমিসল্যাব। গত প্রান্তিকের তুলনায় এই প্রান্তিকে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত ভুল তথ্য ছড়ানোর প্রবণতা বেড়েছে। এর অন্যতম কারণ সেপ্টেম্বরের শেষে পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়িতে ছড়িয়ে পড়া সংঘাত। গত প্রান্তিকে প্রকাশিত মোট স্বতন্ত্র ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনের ৭% ছিল আইনশৃঙ্খলা সম্পর্কিত। যা এই প্রান্তিকে এসে দাড়িয়েছে ১১%।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি এক কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে উত্তাল হয়ে ওঠে পার্বত্য চট্টগ্রামের এই জেলা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে অবরোধকারীদের সংঘর্ষে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর তিনজনের মৃত্যু হয়। আর এই সংঘাতকে কেন্দ্র করে সামাজিক মাধ্যমে পুরোনো ও ভিন্ন ঘটনার ছবি-ভিডিও বা অন্য দেশের দৃশ্য ছড়িয়ে পড়ে খাগড়াছড়ির সংঘাতের দাবিতে।
খাগড়াছড়ির মহাজনপাড়ার রাতের দৃশ্য দাবিতে একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পরে। তবে যাচাই করে দেখা যায় প্রতিবেদনটি পুরোনো ও ইন্দোনেশিয়ার সুরাকারতা শহরের একটি জায়গার। আবার উহ্লামে নামে এক কিশোরীর রক্তমাখা ছবি প্রচার করে দাবি করা হয়, সেনাবাহিনীর গুলিতে সে মারা গেছে। তবে যাচাই প্রতিবেদনে বলা হয় সে বেঁচে আছে এবং মারা যাবার খবরটি ভুয়া। এছাড়া ফেসবুকে এক ব্যক্তির অস্ত্র হাতে ছবি শেয়ার করে দাবি করা হয় প্রকাশ্য দিবালোকে খাগড়াছড়ির মহাজনপাড়া এলাকায় জুম্ম-জনতার উপর প্রকাশ্যে সশস্ত্র হামলা করেছে বাঙালিরা। তবে যাচাই করে দেখা যায় সেটি খাগড়াছড়ির কোনো ঘটনার ছবি নয়, বরং গত বছরের জুলাই আন্দোলনের।
তবে আন্তর্জাতিক ও ধর্ম সংক্রান্ত অপতথ্য কমেছে বলে দাবি করে ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠানটি। আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী সংক্রান্ত ভুল তথ্য জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। দ্বিতীয় প্রান্তিকে যেখানে মোট ভুল তথ্যের ১৯ ভাগ ছিল আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী সংক্রান্ত ছিল। সেটি এ প্রান্তিকে কমে ১ ভাগে এসে দাড়িয়েছে। এবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে ভারত-পাকিস্তান সংঘাত কিংবা ইরান-ইসরায়েল সংঘাতসহ একাধিক আন্তর্জাতিক ঘটনার কারণে ভুল তথ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু তৃতীয় প্রান্তিকে এসে এমন কোনো বড় সংঘাত দেখা যায়নি। ফলে এ সম্পর্কিত ভুল তথ্যও উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। এছাড়া এ প্রান্তিকে এসে ধর্মীয় অপতথ্যও কমতে দেখা গেছে। গত প্রান্তিকে মোট অপতথ্যের ৭% থেকে তৃতীয় প্রান্তিকে ৪% এ থেমেছে ধর্ম সংক্রান্ত ভুল তথ্য।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।