গাজার ১৮ বছর বয়সী দোয়া মুসল্লেম এ বছর হাইস্কুল পরীক্ষায় বেশ ভালো রেজাল্ট করেছেন যে তাকে ফোন করে ‘নায়িকা’ বলে অভিনন্দন জানিয়েছেন ফিলিস্তিনি শিক্ষামন্ত্রী। কিন্তু দোয়ার জন্য এই সাফল্যের আনন্দ ছিল একদিকে মধুর, অন্যদিকে বেদনার চাদরে মোড়ানো।
গাজার ২০২৫ সালের প্রায় ৫৬ হাজার শিক্ষার্থীর মতো তিনিও গত দুই বছর ধরে যুদ্ধের ভয়াবহতায় প্রায় পুরোপুরি ব্যাহত শিক্ষাজীবনের মাঝেই এই ফলাফল অর্জন করেন। ইসরায়েলের হামলায় এ সময় প্রায় ১৯ হাজার শিক্ষার্থী নিহত, হাজার হাজার শিশু অনাথ, এবং পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে।
ভালো রেজাল্ট করে কেমন অনুভূতি এমন প্রশ্নের উত্তরে দোয়া মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে বলেন,
‘বাবা নেই—তাই অসম্পূর্ণ আনন্দ’
দোয়ার বাবা বাসাম মুসল্লেম ২০২৩ সালের নভেম্বরে ইসরায়েলি হামলায় বন্ধু গুরুতর আহত হন। পরে তাকে চিকিৎসার জন্য ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে মিশরে নেয়া হয়। তখন থেকেই তিনি মেয়ের জীবনের বহু গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে অনুপস্থিত—এমনকি তার ভাইরাল হওয়া পরীক্ষার ফল ঘোষণাতেও।
সমাপনী অনুষ্ঠানের ছবি বাবাকে পাঠান দোয়া। এরইমধ্যে ফোনে শিক্ষামন্ত্রী আমজাদ বারহাম তাকে বলেন,
‘তুমি একজন নায়িকা’— কারণ তিনি গাজায় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছেন, ৯৯.৭%।
ধ্বংসস্তুপের মাঝেও গাজাবাসীর বিরল উৎসব দেখা গেলেও, সবার জন্য এই দিনটি আনন্দের ছিল না। দেইর আল-বালাহ’র শিক্ষার্থী দোহা নাজমি আবু দালাল প্রায় পূর্ণ নম্বর পেয়েছিলেন; কিন্তু ফল জানার আগেই তিনি নিহত হন। যুদ্ধবিরতির কয়েক সপ্তাহ পর—২৯ অক্টোবর ইসরায়েলি হামলায়—তার সঙ্গে নিহত হন তার পরিবারের আরও ১৭ সদস্য।
ইউনিসেফ জানায়, অক্টোবর ২০২৩ থেকে ইসরায়েলের বোমাবর্ষণে গাজার শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা একে বলেছেন ‘scholasticide’, অর্থাৎ একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা।
ইসরায়েল দাবি করে, হামাস স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় সামরিক কাজে ব্যবহার করে—যদিও শিক্ষা ধ্বংসের অভিযোগের সরাসরি জবাব তারা দেয়নি।
ইউনিসেফের তথ্যমতে, গাজার ৯৭% স্কুল ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে।
ফিলিস্তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী—এখন পর্যন্ত ১৮,৫৯১ শিক্ষার্থী নিহত এবং ২৭,২১৬ জন আহত হয়েছেন। পাশাপাশি, ৭৯২ শিক্ষক নিহত এবং ৩,২৫১ শিক্ষক আহত হয়েছেন
তবে, প্রশ্ন হচ্ছে যুদ্ধের মধ্যে কীভাবে পড়াশোনা করেছেন গাজার শিক্ষার্থীরা?
উত্তরে খান ইউনিসের এক আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা শিক্ষার্থী আল-হাসান আলি রাদওয়ান বলেন, ‘ইন্টারনেট নেই, বিদ্যুৎ নেই, পানি নেই, খাবার নেই—এই পরিস্থিতিতে অনলাইনে পড়াশোনা করা কঠিন ছিল।’
যুদ্ধে তিনি এক আত্মীয় এবং পড়ার সঙ্গীকেও হারিয়েছেন।
বর্তমানে, গাজার ৫৬ হাজার নতুন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য প্রস্তুত। কিন্তু সমস্যা হলো— নেই বিশ্ববিদ্যালয়। যা ছিল, সেগুলো গুঁড়িয়ে দিয়েছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী।
গাজার শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, গত দুই বছরে ৬৩টি বিশ্ববিদ্যালয় ভবন সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়েছে। অন্যদিকে শিক্ষাসামগ্রী—খাতা, ব্যাগ, স্টেশনারি সব ধংস হয়ে গিয়েছে।
ইউনিসেফ বলছে, গাজার ৯২% শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুনর্নির্মাণ বা বড় সংস্কার ছাড়া চালু করা সম্ভব নয়।
তবে শিক্ষার্থী দীমার বাবা আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন,
‘গাজার সব ক্ষত থাকার পরও আমরা খুশি হতে চাই। ছাত্রছাত্রীদের যত দ্রুত সম্ভব শ্রেণিকক্ষে ফিরতে হবে।’
অন্যদিকে অনেক শিক্ষার্থী বিদেশে পড়াশোনার সুযোগ চাচ্ছেন।
সম্প্রতি উত্তীর্ণ মোহাম্মদ বিলাল আবু ফারাজ বলেন,
‘এটা কোনো জীবন নয়—ওরা আমাদের স্কুল-কলেজ সব ধ্বংস করে দিয়েছে। সীমান্ত খুলে দিন। আমরা দেশের বাহিরে পড়ালেখা করতে চাই’
দোয়ার স্বপ্নও তার বাবার অবস্থার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। বাবার আঘাত তাকে নার্সিং পড়ার অনুপ্রেরণা দিয়েছে। সে আশা করে—বিদেশে পড়তে পারবে এবং একদিন বাবার সঙ্গে আবার মিলিত হবে।