হাকিম আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ওসি হেলালের আপিলের শুনানি শেষে ঢাকার পঞ্চম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ জাহিদুল কবির বুধবার এই রায় ঘোষণা করেন।
কাদেরের অন্যতম আইনজীবী শুভ্র সিনহা রায় জানান, হাকিম আদালতের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে গত বছরের জুন মাসে আপিল করেছিলেন ওসি হেলাল।
চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত হেলাল বর্তমানে হাই কোর্ট থেকে জামিনে রয়েছেন। ঘটনার সময় তিনি ছিলেন খিলগাঁও থানার ওসি। সাময়িক বরখাস্ত হওয়ার পর তাকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়।
আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র কাদের এখন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের রসায়ন বিভাগের প্রভাষক। এই রায়ে তিনি সন্তুষ্ট বলে জানিয়েছেন।
কাদের বলেন, “আর কোনো ছাত্র যেন ওসি হেলালের মতো কোনো পুলিশ কর্মকর্তার নির্যাতনের শিকার না হন।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র আবদুল কাদের এখন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের রসায়ন বিভাগের প্রভাষক
কাদের বলেন, “ওসি হেলাল আপস করার জন্য বিপুল পরিমাণ টাকা দিতে চেয়েছিলেন। আমি রাজি হইনি। কারন এ রকম পুলিশ কর্মকর্তার মত আর কারও যেন পুলিশে বাহিনীতে জায়গা না হয়। তার দৃষ্টান্ত থাকা দরকার। আমি আপস করলে ও জিতে যেত।”
২০১১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিভাগের তৎকালীন ছাত্র কাদেরকে আটকের পর তাকে ছিনতাইকারী হিসেবে দেখানোর জন্য থানায় নিয়ে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করেন ওসি হেলাল। কিন্তু স্বীকারোক্তি না পেয়ে চাপাতি দিয়ে তার পায়ে আঘাত করেন।
ওই মামলার রায়ে গতবছর ১৭ মে হেলালকে তিন বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আলমগীর কবীর রাজ। পাশাপাশি হেলালকে দশ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও তিন মাসের কারাদণ্ড দেন তিনি।
রায়ের সময় অনুপস্থিত হেলাল উদ্দিনের পক্ষে তার আইনজীবী সাইদুর রহমান সময়ের আবেদন করেছিলেন। আদালত তা নাকচ করে হেলালকে পলাতক দেখিয়েই এ রায় ঘোষণা করে।
ওই রায়ে বলা হয়, পুলিশের কাজ জনগণকে নিরাপত্তা দেওয়া। সেই পুলিশ যদি নির্যাতন করে তা নিন্দনীয়, অমানবিক এবং দায়িত্বের চরম অবহেলা।
মামলার নথি থেকে জানা যায়, ২০১১ সালের ১৬ জুলাই খালার বাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে ফেরার পথে সেগুন বাগিচায় দুর্নীতি দমন কমিশন কার্যালয়ের সামনে সাদা পোশাকের পুলিশ কাদেরকে আটক করে। কাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসাবে পরিচয় দেওয়ার পরও তাকে নিয়ে যাওয়া হয় খিলগাঁও থানায়।
ওই থানার তখনকার ওসি হেলাল তার কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য মারধর করেন। এক পর্যায়ে থানার টেবিলে রাখা একটি চাপাতি নিয়ে ‘দেখি তো চাপাতিতে ধার আছে কি না’ বলে কাদেরের বাঁ পায়ের পেছন দিকে মাংশ পেশিতে আঘাত করেন।
গুরুতর আহত কাদেরকে এরপর দীর্ঘদিন হাসপাতালে কাটাতে হয়। এরইমধ্যে ২১ জুলাই তাকে মোহাম্মদপুর থানার একটি গাড়ি ছিনতাই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরে খিলগাঁও থানার অস্ত্র ও ডাকাতি চেষ্টার দুটি মামলায় আসামি করা হয় তাকে, যদিও এসব মামলার এজাহারে তার নাম ছিল না।
আবদুল কাদেরকে নির্যাতনের একমাত্র প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন ওই থানার কনস্টেবল আবদুল করিম।
হাকিম আদালতে জবানবন্দিতে তিনি বলেছিলেন, ঘটনার দিন তিনি রাত ৪টা থেকে ৬টা পর্যন্ত ডিউটিতে ছিলেন। ভোর সাড়ে ৪টার দিকে এসআই আলম বাদশা কাদেরকে আটক করে থানায় নিয়ে যান। ডিউটি অফিসার মো. আসলামের নির্দেশে তাকে হাজতে আটক রাখা হয়।
পরদিন থানায় এসে ওসি হেলাল লকার খুলে কাদেরকে তার কক্ষে নিয়ে যেতে বলেন। ওসি হেলালের কক্ষে রেখে এসে কনস্টেবল করিম কিছুক্ষণ পর কাদেরের চিৎকার শুনতে পান এবং গিয়ে দেখেন, ওই শিক্ষার্থী রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন; তার বাঁ পা রক্তাক্ত।
মামলার অপর সাক্ষী খিলগাঁও থানার তখনকার ডিউটি অফিসার এসআই আসলাম মিয়াও আদালতে জবানবন্দিতে একই কথা বলেন।
কাদেরের ওপর পুলিশি নির্যাতনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। বিষয়টি গণমাধ্যমেও ব্যাপক আলোচিত হয়। এরপর হাই কোর্টের নির্দেশে একটি তদন্ত কমিটি করে পুলিশ।
এ বিষয়ে তদন্তের মধ্যেই হাই কোর্টের নির্দেশে খিলগাঁও থানার তখনকার ওসি হেলালউদ্দিন এবং কাদেরকে গ্রেপ্তারের অভিযানে যাওয়া এসআই আলম বাদশাহ ও এএসআই শহীদুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
পুলিশের তদন্তে তিন মামলাতেই নির্দোষ প্রমাণিত হন কাদের। এরপর আইন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ২০১২ সালের ২৩ জানুয়ারি তিনি ওসি হেলাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
ওই বছর ২৬ মার্চ আসামি হেলালের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন এ মামলার তদন্ত কর্মকর্ত উপ-পরিদর্শক মো. আবু সাঈদ আকন্দ।
২০১২ সালের ১ অক্টোবর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে হাকিম আদালতে এ মামলার বিচার শুরু হয়। ১৩ জনের সাক্ষ্য শুনে হাকিম তিন বছরের সাজার রায় ঘোষণা করেন।
প্রকাশক ও সম্পাদক: মো: আব্দুল করিম
সম্পাদকীয় কার্যালয়: এস করিম ভবন, তৃতীয় তলা ৪৩, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, নিউমার্কেট ঢাকা- ১২০৫
ফোন: 02 9356582, মোবাইল: 01715635623, ইমেইল: somoykontho@gmail.com